অর্বাক আদিত্য
অনলাইন অফলাইন প্রিন্ট ইলেকট্রিক সোশ্যাল আন-সোশ্যাল সব মিলিয়ে এখন বাংলাদেশের মিডিয়ার সংখ্যা সঠিক কত হয়তো এই তথ্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার কথাই ধরা যাক, যদিও সেটি ব্যক্তিগত। সেখানে প্রকাশিত সমস্ত বক্তব্য বা দেখার চোখটা ব্যক্তির। কিন্তু সেই মাধ্যমটি যখন পাবলিকলি সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে, তখন তারও তো একটা দর্শন, রুচির প্রশ্ন ওঠে। মত, চিন্তা চেতনা বোধ বুদ্ধিরও বিচার করতে হয়। লোকপ্রিয় এই মাধ্যমটিতে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান প্রায় সকলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, নিজেদের মতামত, মতাদর্শ, চিন্তা, চাওয়া পাওয়াকে উপস্থাপনের জন্য। এই সময়টাকে অনেক বর্ষীয়ান ব্যক্তি, চিন্তকেরা বাতিল করছেন, অনেকে সেই বাতিলের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, অনেকে বিপক্ষে।
এখন পক্ষ বিপক্ষের মাধ্যমেও কিন্তু একধরনের চিন্তাকে প্রতিষ্ঠা করার মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। হোক সেটি চেতনে বা অবচেতনে। সোশ্যাল মিডিয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম ফেসবুক। এই মাধ্যমটিকে ধার্তব্যে এনে যদি বিষয়টা সম্পর্কে বলা যায়, সম্ভবত সবাই বুঝবেন। ফেসবুকই সহজ ব্যবহার মাধ্যম। সহজেই পোস্ট, শেয়ার, মন্তব্য করা যায়।
কোন একটি বিষয় নিয়ে যখন ফেসবুকে ট্রল হয় তখন বুঝে করুক আর না বুঝেই করুক বা কারো চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েই করুক অধিকাংশই বিষয়টির ওপর নিজস্ব মতামত প্রদান করেন
একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখা যাবে, কোন একটি বিষয় নিয়ে যখন ফেসবুক ট্রল হয় তখন বুঝে করুক আর না বুঝেই করুক বা কারো চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েই করুক অধিকাংশই বিষয়টির ওপর নিজস্ব মতামত প্রদান করেন। ধরুন, একটা খুন হলো বা একটা ধর্ষণ বা একটা প্রশংসাসূচক কোন কাজ, যেটি সম্পর্কে সবাই কথা বলছে, তখন ব্যক্তি সেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক হয়ে ওঠেন। এটা একটা ট্রেন্ড। কারো সম্পর্কে জানেই না, তার পোস্টে গিয়ে অনর্গল প্রশংসা করেই যাচ্ছেন। কিংবা কারো জন্মদিন বা কারো প্রয়াণে গণ শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা প্রদানের একটা সার্কাস লক্ষ্য করা যায়। যেমন কদিন আগে ছদরুল (মি. আমানউদ্দিনের বাড়ির গেটম্যান, যিনি প্রাইমারীতেই ইতি টেনেছেন) আইন আদালত নিয়ে তার ফেসবুকে একটা পোস্ট করলেন; তো সেই পোস্ট দেখে তার মালিক মি. আমানউদ্দিন বললেন, ‘কি রে ছদরুল, তুই আইন আদালও বুঝিস নাকি? জানতাম না তো। তুই যা বলিছিস, তা কি ঠিকই বলিছিস?’ ছদরুলের জবাবটাই বর্তমান সময়টাকে পরিস্কার করে দেবে। ছদরুল বলছে, ‘কর্তা, সবাই কতিছে, আমি যদি না কই, তাইলে এই ফেসবুক থাকনের লাব কি?’ তাহলে তুইও কি পালের ভেতর হাক্কা হুয়া করেছিস? মি. উদ্দিনের এই প্রশ্নের জবাব অবশ্য ছদরুল দেননি। কিন্তু উত্তরটা তো হ্যাঁ-ই হবে। যাক সেকথা। যিনি একটা লাইন পর্যন্ত লিখতে পারেন না, ভুল বাক্য লেখেন। তিনিও ব্যাকরণের মাস্টার। এটা ঘটছে। এখন আপনি কোন পক্ষ নেবেন? এই সময়টা সঠিক? নাকি ভুল রাস্তায় আছে?

আর একটা বিষয় শো- আপ। যা ছোটলোকি চালচলন, তাই ফেসবুককালে এসে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। শোআপ বিষয়টা যে ছোটলোকি চলন, এটা দাদীর কাছে ছোটবেলায় শিখেছি। আমি তো ছোটলোকি পরিবারের সন্তান, দাদী কিন্তু খাচ্চা এলিট। তো একবার হলো কি, ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা। আব্বা, একটা নতুন প্যান্ট আর একটা শার্ট এনে দিলেন। এই শার্ট প্যান্ট পেয়ে তো এমন অবস্থা দাঁড়ালো, পরীক্ষার রুটিনই ভুলে গেছিলাম। নতুন শার্ট প্যান্ট পরে পাড়ায় চক্কর দিতে যাবো। মানে শো-আপ। দাদীর সামনে বারবার হাঁটছি। দেখি, কিচ্ছু বলে না। কিন্তু আমার সেই ছোট্টলোকি চাওয়াটা আর বেশিক্ষণ ভেতরে রাখতে পারলাম না। বলেই বসলাম, নতুন শার্ট প্যান্ট পরেছি দাদী ক্যানবা কিছুই কয় না। দাদী এই মন্তব্য পাওয়ামাত্র মুচকি করে হেসে দিলেন। বললেন, বস। অনেকক্ষণ কথা বললেন, যার সারমর্ম দাঁড়ায়। তোকে সুন্দর লাগছে। কিন্তু এই যে মন্তব্য চাওয়া। এবং দেখানদারী এগুলা ছোটলোকি। এগুলারে ছাড়তে না পারলে। অন্যকাজে মনোযোগী হবি কি করে। সেদিন কেন যেন দাদীর কথাগুলোরে মনোযোগ সহকারে গ্রহণ করেছি। জানি না, একজন আন-একাডেমিক মানুষ কি করে, একটা প্রত্যন্ত এলাকায় থেকে। এই বোধের চর্চা করলেন। এখন বিস্ময় লাগে। এই সময়টা চলছে শোআপের। নতুন ফ্রিজ কিনেছি, ছবি দাও। নতুন বাড়ি, গাড়ি, সোনা গহনা, স্যুট বুট টাই, রেস্টুরেন্টের দামী খাবার এমনই পরিস্থিতি যেন মানুষকে না দেখালে সেই খাবার খেয়ে লাভ কি? মানুষই যদি না দেখলো তাহলে এই পোশাকের প্রয়োজনীয়তা কি? এটা একটা মানসিক দৈন্যতা। তবে রুচিভেদে, উপস্থাপনের ইনটেলেক্টে এই দৈন্যতা কখনো কখনো অভিজাত বলে সুনাম পায়। কিন্তু সেটাও মানসিক দৈন্যতা-ই।
এখানে যে কেউ যে কোন সময় রহিম রূপবান, শিরি ফরহাদ, লাইলি মজনু, রাধা কৃষ্ণ, ইউসুফ জোলেখা হতে পারে

আর একটা ব্যাপার সস্তা জনপ্রিয়তার আকাক্সক্ষা। এই প্রবণতা মহামারীর মতো। কেউ দেখা গেল মুখ দেখিয়ে একহাজার জনের কাছে পৌঁছেছে। আএকজন তখন তাকে অভারটেক করার জন্য বুক দেখালো। আরএকজন নাভি। মোটকথা জনপ্রিয়তা, সেলিব্রেটি। প্রতিযোগিতা চলে। কেউ হয়তো মেধার কারণে জনপ্রিয়তা পেল, তখন তাকে টেক্কা দেবে কি করে। চাইলে, বুকের জায়গায় মুখ দেখানো যায় কিন্তু মেধাবী হওয়া যায় না। তখন চলে আসে হীনমন্যতা। অন্যেরে নকল কর। ভঙ্গি নকল কর বা টেকনিক নকল কর। তার গাছের জায়গায় বৃক্ষ বসাও। চাঁদের জায়গায় চন্দ্র বসাও। এই চলছে। তখন আপনি কার পক্ষ নেবেন?
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সবচেয়ে বেশি গাঢ় মারামারি হয়েছে। ভালোবাসার বা প্রেমের। এখানে যেকেউ যেকোন সময় রহীম রূপবান, শিরি ফরহাদ, লাইলি মজনু, রাধা কৃষ্ণ, ইউসুফ জোলেখা হতে পারে। দুচারটা প্রেমের কবিতার লাইন, দুএককলি গানের লাইন, আর শাকিব খানের সিনেমার কিছু সংলাপ নিয়ে হাবুগবুদের প্রেমকাহিনী রচনা হয়। শেষে দেখা যায়, গভীর এক দার্শনিক মন্তব্য। আসলে প্রেম বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই। নিজের ভেতরে যে কিছু নেই এটা স্বীকার করতে চায় না। এই চলছে, তাহলে আপনি কার পক্ষ নেবেন?
Add Comment