মারুফ ইসলাম
বিকেলটা আর বিকেল থাকল না, রক্তদহ বিলের মতো শুকিয়ে আধমরা হয়ে গেল। আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি মাত্র, চৈত্রের আকাশে হলুদ আলোর বন্যা, ঠিক তখনই মায়ের ফোন। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা হয়, মায়ের ফোন পেলে বিকেলগুলো মরে যায়। মার ফোনকল যেন জীবনসুধা শুষে নেওয়ার অদ্ভুত এক যন্ত্র। আমি রিসিভ করলাম। মা বললেন, অফিস থেকে বেরিয়েছিস বাবা? আমি জবাবে বললাম, হু। ‘আসার পথে একটু সিলিন্ডারের দোকান হয়ে আসিস। তোর আব্বার…।’ কথা শেষ হলো না। কেটে গেল। অনুমান করি, মায়ের ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে। গত পরশু কুড়ি টাকা ভরে দিয়েছিলাম। কুড়ি টাকা দিয়ে আর কতদিন? আমার উচিত এখনই ফোনকল ব্যাক করা।
আব্বার কী হয়েছে জানা দরকার। শ্বাসকষ্ট কি বেড়ে গেছে? হাসপাতালে নিতে হবে? বাসায় তো অক্সিজেনের সিলিন্ডার আছেই। নাকি সেটাও শেষ? শেষ হওয়া অবশ্য বিচিত্র কিছু নয়। আব্বা ইদানিং একটু বেশিই অক্সিজেন খরচ করছেন। বয়স হলে যা হয়। খাঁই খাঁই স্বভাব বাড়ে। যতই বোঝানোর চেষ্টা করি, একজনের বেতন দিয়ে পাঁচজনের সংসার চালানো যায় না। খুব কষ্ট হয়। কে শোনে কার কথা? মা বলেন, তিনি বেশি খান না। কিন্তু ছোটবোন মুনিয়া সেদিন ফিসফিস করে যা জানালো, তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ! মা নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে অক্সিজেন খান! ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। পাঁচজনের সংসারে এক সিলিন্ডার দিয়ে একমাসও যাচ্ছে না।
বলে রাখা দরকার, আমরা ইনহেলারের যুগ অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি। আগে ছোট্ট একটা ইনহেলার মুখে ঢুকিয়ে দুটো পাফ নিলেই বুকভরে শ্বাস নেওয়া যেত, এখন আর যায় না। সেই দিন তিরোহিত। আগে প্রত্যেকের পকেটে পকেটে অক্সিজেনের ইনহেলার থাকত, এখন প্রত্যেক ঘরে ঘরে অক্সিজেনের সিলিন্ডার। ঘরে বাইরে কোথাও কোনো গাছ নেই। অক্সিজেন আসবে কোত্থেকে? তাই এই ব্যবস্থা। আমি মোবাইল ফোনে মার নম্বরে ডায়াল করতে চাই। আব্বার কী হয়েছে জানা প্রয়োজন। যদি গুরুতর অসুস্থ হোন, আমাকে এক্ষুণি কালবিলম্ব না করে বাসায় যেতে হবে। সন্তান হিসেবে এটাই এখন কর্তব্য। কিন্তু পৃথিবীর সব সন্তান কী কর্তব্য পালন করছে? এই তো সেদিন কোনো এক ভাগাড়ে এক বৃদ্ধ মাকে ফেলে গেছে সন্তানেরা। এটা নিঃসন্দেহে একটা খারাপ উদাহরণ। এই খারাপ উদাহরণটাই কেন মনে পড়ল? ভালো উদাহরণও তো আছে। অনেক সন্তানই তো মা বাবার দায়িত্ব পালন করছে। সেসব কেন মনে পড়ল না?

আমাদের বাড়ির উঠোনের এক কোণায় একটা নিম গাছ আছে। আশেপাশের দশ জেলার মধ্যে একমাত্র গাছ
মনের মধ্যে মল্লযুদ্ধ চলে আমার। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমি পকেট থেকে ইনহেলার বের করে পরপর তেরটা পাফ নিই। তারপর দেখি ইনহেলার কাজ করছে না। অক্সিজেন শেষ হয়ে গেছে। ফুটপাতের পাশে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে থাকা ইনহেলার রিচার্জারের কাছ থেকে ইনহেলার রিফিল করে নিই। আগে রাস্তার পাশে এভাবে মোবাইলের রিচার্জাররা বসে থাকত। তাদের কাছ থেকে মোবাইলে টাকা রিচার্জ করা যেত। এখন অক্সিজেনের রিচার্জাররা বসে থাকে। আমি ইনহেলার মুখে পুরে আরো দুটো পাফ নিয়ে ধাতস্থ হই। আমার মনে পড়ে ভালোবাসার সমান বয়সী এক বালিকাকে, যার নাম তরু, যাকে আমি ভালোবাসি বলে নিজেই নিজের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়ে রেখেছি; সেই তরু একদিন আমাকে ভেজামেঘের মতো নরোম গলায় বলেছিল, আমাকে একটা বেলিফুল গাছের অক্সিজেনের ইনহেলার কিনে দিবে? আমি ‘দিব’ বললেও আজও কিনে দিতে পারিনি। ছোটবোনটার বিয়ে আটকে আছে নিমগাছের অক্সিজেনওয়ালা দুটো প্রমাণ সাইজের সিলিন্ডার উপহার দেয়ার সামর্থ অর্জন করতে পারছি না বলে। না না, এটা যৌতুক-টৌতুক ধরনের কিছু নয়, আগে যেমন বিয়ের সময় কণের ঘর সাজিয়ে দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল—এই ধরুন টিভি, ফ্রিজ, ফার্নিচার ইত্যাদি; এখন সেখানে অক্সিজেনের সিলিন্ডার দিতে হয়। সময়ের সাথে কত কিছুই না বদলায়। এখন ভালোবাসায়, কর্তব্যে, আবেগে, আবদারে, ব্যবসায়, ছলনায়— সবকিছুতেই সিলিন্ডার। অক্সিজেনের সিলিন্ডার!
আমি হাঁটতে হাঁটতে প্রায় বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। মাকে একটা ফোন করি। সংসারের অন্যকিছুও তো প্রয়োজন হতে পারে। হয়তো তেল নেই। কিংবা গুড়ো মরিচ শেষ হয়ে গেছে। আমি মাকে ফোন করি। মা ফোন ধরেই বলেন, জলদি আয়। তোর উকিল চাচা কখন থেকে বসে আছে! মা ইদানিং কথায় তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। তারও তো বয়স হলো! আমি যখন অফিস থেকে বের হই তখন মা ফোন করে সিলিন্ডারের কথা বলেছিলেন। আর এখন বলছেন উকিল চাচার কথা। উকিল চাচা এলো কোত্থেকে? বাসায় ঢুকে দেখি সত্যি সত্যি উকিল চাচা বসে আছেন। আব্বা বসে আছেন। মা বসে আছেন। ছোট দুই বোন বসে আছে। ঘটনা কি? সবাই কিসের আয়োজন করছে? তারপর উকিল চাচা ও আব্বার কাছ থেকে যা শুনলাম, তাতে আমার চোখে পানি চলে এলো। আমাদের বাড়ির উঠোনের এক কোণায় একটা নিম গাছ আছে। আশেপাশের দশ জেলার মধ্যে একমাত্র গাছ। সেই গাছ আব্বা আমাদের তিন ভাইবোনের নামে উইল করে দিচ্ছেন। আব্বার ভাষ্য, অদূর ভবিষ্যতে এই গাছ নিয়ে আমাদের মধ্যে ভীষণ ক্যাচাল হবে। সেই ক্যাচাল যাতে না হয়, সেই জন্য উকিল চাচাকে ডেকে এনেছেন। উকিল চাচা আমাদের নামে সমানভাবে ভাগ করে উইল তৈরি করেছেন। সবার স্বাক্ষর দেওয়া শেষ। আমার স্বাক্ষর বাকি। আমি উইলপত্র হাতে নিয়ে গভীর আবেগে আক্রান্ত হলাম। আমার চোখ ভারি হয়ে এলো। এ রকমই হয়, যখন গভীর আবেগ আমাকে গ্রাস করে, আমি তখন চোখ খুলে থাকতে পারি না।
Add Comment