রাফিউজ্জামান রাফি
যেখানে সাগরের মাঝিদের পথ দেখায় কবিতার পাহাড়, রয়েছে ভাসমান গ্রাম আর উপকূলজুড়ে বিস্তৃত ছড়ানো ছিটানো অজস্র সৌন্দর্য
পৃথিবীতে সব ধরনের মানুষের সব চাহিদার শেষ থাকলেও যারা ঘুরতে ভালবাসেন তাদের চাহিদার (ভ্রমন পিপাসুদের চাহিদার) বোধহয় শেষ নেই। তাদের অনুসন্ধিৎসু মন ও চোখ সর্বদা নতুন জায়গার সন্ধানে থাকেন আর সন্ধান পেলেই সুযোগের অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকেন আর ভাবেন, ‘কখন সেখানে যাওয়া হবে’। আমার মনে হয় অভিযানপ্রিয় এই মানুষগুলো জীবনে শেষ সময়ে এসেও হয়তো ভাবেন কোথায় কোথায় ঘোরা বাকি রইলো, আর মনে মনে হয়তো সিদ্ধান্ত নেন সেরে উঠলেই জায়গাগুলো থেকে ঘুরে আসবেন। সৃষ্টিকর্তাও তার অপার সৃষ্টি এই পৃথিবীতে এই ভ্রমনপিপাসু মানুষগুলোর চাহিদা পূরণে একটুও কার্পণ্য করেননি।

তাদের জন্য রেখেছেন অগণিত আশ্চর্য, আলতো সৌন্দর্য মণ্ডিত কিংবা ভয়ংকর সৌন্দর্যমণ্ডিত হরেক রকম দর্শনীয় স্থান। এই দর্শনীয় স্থানগুলো পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই ভ্রমণ পিপাসু মানুষগুলোকে এক অদৃশ্য মায়াজালে বেধে রেখেছে। যার মোহতে মানুষগুলোও বার বার অভিযানের নেশায় তাদের কোলে ছুটে যায়, ছুটে যায় নতুন নতুন জীবনধারার সাথে পরিচিত হতে, ছুটে যায় নতুন আকাশে নিজেকে মেলে দিতে কখনো পাহাড়ে, কখনো সাগরে আর কখনোবা সমতল ভূমিতে। ঠিক এমনই এক নতুন জীবনধারা, আশ্চর্য সৌন্দর্যের মায়াজাল বিছানো অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভিয়েতনামের হ্যা লং বে। যুগ যুগ ধরে দর্শনার্থীদের চোখে ও স্নায়ুতে বুলিয়ে দিচ্ছে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আশ্চর্য জীবন ধারার এক সুশীতল পরশ। যেখানে রয়েছে কবিতার পাহাড়, রয়েছে ভাসমান গ্রাম আর উপকূলজুড়ে বিস্তৃত ছড়ানো ছিটানো অজস্র সৌন্দর্য।
হ্যা লং বের ভৌগলিক উৎপত্তি
হ্যা লং বের ভৌগলিক উৎপত্তির দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাস পড়লে জানা যায় আজকের এই চোখ ধাধানো সৌন্দর্যের তীর্থভূমি হ্যা লং বে সৃষ্টি হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন বছরেরও অধিক সময় নিয়ে। অর্থাৎ ৫০০ বছরের ক্রমবর্ধমান পাহাড়, সামুদ্রিক ক্ষয়, ডুবন্ত পাহাড় এবং সমুদ্রের অচলাবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বর্তমান চেহারায় স্থায়ীত্ব পেয়েছে এই হ্যা লং বে। ওডভিক-সিলুয়া যুগে হ্যা লং ছিল একটি গভীর সমুদ্র, এরপর কাকবন- পেকমি যুগে এটি অগভীর সমুদ্রে রুপ নেয়। পরবর্তীতে প্লাজন-নিউগেন যুগে এটি উপকূল অঞ্চলের চেহারা ধারণ করে। পরবর্তীতে নান্দনিক চুনাপাথরের সংযোজনে, সাথে উপযোগী আবহাওয়ার প্রভাবে হ্যা লং আজকের নান্দনিক উপকূলে রুপ নিয়েছে।

হ্যা লং বে র উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত গল্প
বিজ্ঞান রূপকথাকে পাত্তা না দিলেও জনসাধারাণ ঠিকই রূপকথাকে পাত্তা দিয়ে থাকে। কখনো কখনো তো তারা বিজ্ঞানকে এড়িয়ে রূপকথাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে । হ্যা লং বের সৃষ্টি নিয়েও সেখানকার জনমনে প্রচলিত আছে এক রুপকথা। আর এই হ্যা লং নামকরণ কিন্তু রূপকথার গল্প অনুযায়ীই। হ্যা লং অর্থ মাটিতে বা ভূমিতে নেমে যাওয়া ড্রাগন। স্থানীয়রা মনে করেন প্রাচীনকালে এই অঞ্চল ছিল জলদস্যু কবলিত। জলদস্যুদের সাথে তাদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো। সে সময় এ জনপদকে জলদস্যুদের কবল থেকে রক্ষা করতে এবং জলদস্যুদের শায়েস্তা করতে ঈশ্বর এখানে একটি ড্রাগন পরিবার পাঠালেন।

এই ড্রাগনদের থুথু থেকেই উপকূলে সৃষ্টি হয় অসংখ্য মূল্যবান মনি মুক্তো যা দেখে ঐ জলদস্যুরা জাহাজ নিয়ে সেগুলো আনতে ছুটতে থাকে। কিন্তু পথিমধ্যে পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে জাহাজটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সকল জলদস্যু ধ্বংস হয়ে যায়। অতঃপর জলদস্যুমুক্ত হ্যা লঙে আবার শান্তি ফিরে আসে। ওদিকে ঐ ড্রাগন পরিবারের প্রতি ঈশ্বরের নিকট হতে ফিরে যাওয়ার ডাক আসে। কিন্তু তারা হ্যা লঙের সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ ছিল যে হ্যা লঙের এই মনোমুগ্ধকর স্বর্গীয় পরিবেশ ছেড়ে তারা যেতে চাইছিল না। তাই তারা সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার আবেদন জানায় ঈশ্বরের নিকট। ঈশ্বর আবার এই ড্রাগন পরিবারের ওপর তাদের কার্যক্রমের কারণে সন্তুষ্ট ছিলেন বিধায় তাদের সেখানে থেকে যেতে অনুমতি দেন। তারপর থেকে ড্রাগন পরিবারটিও এই উপকূলেই বাকী জীবন কাটিয়ে দেয়। মা ড্রাগনটি যেখানে অবস্থান নিয়েছিল সে জায়গার নামকরণ করা হয় হ্যা লং আর শিশু ড্রাগন যেখানে অবস্থান নিয়েছিল সে জায়গাটির নামকরণ করা হয় বাই তু লং নামে।
হ্যা লঙে দাঁড়িয়ে আছে কবিতার পাহাড়
হ্যা লং উপকূলে আপনাকে বরণ করে নিতে দাঁড়িয়ে আছে ২০০ মিটার উঁচু এক কবিতার পাহাড়। কবিতার পাহাড় নাম শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন পাহাড় আবার কবিতার হয় কিভাবে? পাহাড়টা কবিতা দিয়ে তৈরি নাকি? আপনাদের মতো আমিও একটু অবাক হয়েছিলাম পাহাড়ের এমন নাম শুনে। পাহাড়টির নাম কবিতার পাহাড় হওয়ার অবশ্য একটি গল্প আছে। তা জানতে হলে আমাদের পাঁচশো বছরেরও পিছনে চলে যেতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা জীবন ধারনের জন্য সাধারনত সম্পূর্ণরুপে সাগরের উপর নির্ভরশীল। হ্যা লং বেও তার ব্যাতিক্রম নয়। প্রাচীনকাল থেকেই হ্যা লঙের অধিবাসীরা জীবিকা নির্বাহের জন্য সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল।

তারা মাছ ধরাসহ বিভিন্ন কাজে গভীর সমুদ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতো। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে গভীর সমুদ্র থেকে মাঝিদের পথ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে যেত এই ২০০ মিটার উঁচু পাহাড়। সে সময় ছিল না প্রযুক্তি, এমনকি আবিষ্কার হয়নি কম্পাসও। আর তাই সমুদ্রের মাঝিরা ঘরে ফিরতে নির্ভরশীল ছিল এই পাহাড়ের উপর। পাহাড়ের চূড়ায় জ্বলতো মশাল। আর এই মশাল অনুসরণ করেই গভীর সমুদ্র থেকে ঘরে ফিরতো হ্যা লঙের মাঝিরা। তখন কিন্তু এই পাহাড়ের নাম কবিতার পাহাড় হয়ে উঠেনি। তখন এ পাহাড়কে স্থানীয়রা ডাকতো ট্রুয়েন ড্যাং নামে। ট্রুয়েন ড্যাঙের ইংরেজী হচ্ছে লাইট হাউজ। কিন্তু ১৪৬৮ সালে লি থান টাঙের এই পাহাড়কে নিয়ে লেখা একটি কবিতা এই পাহাড়ের চূড়ায় খোদাই করে লেখা হয়। সেই থেকে এই পাহাড়ের নাম হয়ে বাই থো নু, যার ইংরেজী করলে দাঁড়ায় পোয়েম মাউন্টেন।
পোয়েম মাউন্টেনের বিশেষত্ব
বাই থো নুই তথা পোয়েম মাউন্টেনের বিশেষত্ব হচ্ছে সম্পূর্ণ হ্যা লং বের সৌন্দর্য ওপর থেকে উপভোগ করতে এটি যেন এক প্রাকৃতিক টাওয়ার। মাত্র ৩০ মিনিট সময় ব্যায়ে ২০০ মিটার উচ্চতার এই পাহাড় চূড়ায় উঠেই আপনি দেখতে পাবেন সেখানে পতপত করে ওড়া ভিয়েতনামের সার্বভৌমত্ব জানান দিচ্ছে ভিয়েতনামের বিপ্লবী লাল পতাকা।

আর তার পাশেই শোভা পাচ্ছে কিং লা থানের পাথরে খোদাই করা কবিতাটি যে কবিতার জন্য ট্রুয়েন ড্যাং হয়ে গিয়েছে বাই থো নুই তথা কবিতার পাহাড়। এবার সেই চূড়ায় দাঁড়িয়ে একটু চোখে মেলে তাকালেই আপনার চোখের ফ্রেমে বাধা পড়বে সৃষ্টিকর্তার হাতে বিছিয়ে রাখা নান্দনিক সৌন্দর্যের হ্যা লং বে। আপনি দেখতে পাবেন সমুদ্রে ছড়ানো ছিটানো প্রায় দুই হাজার চীনা মাটির পাহাড়। যা আপনাকে দৃষ্টিতে বুলিয়ে দেবে সবুজ ও প্রশান্তির ছোয়া।
সাগরের বুকে ভাসমান গ্রাম
বৈচিত্রময় এই পৃথিবীতে বৈচিত্রের শেষ নেই। এ বৈচিত্র্য এমনই বৈচিত্র্য যে, চলতে ফিরতে আমরা হঠাৎ এমন কিছু দেখি অথবা নাম শুনি যা এর আগে কখনো দেখা হয়নি, শোনা হয়নি এবং ভাবিষ্যতেও দেখা হবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। এমন এক অবাক স্থাপনা রয়েছে হ্যা লঙে। আর তা হচ্ছে ভাসমান গ্রাম। আমরা ভাসমান সেতু দেখেছি, ভাসমান বাজার দেখেছি, ভাসমান আরও অনেক কিছুর কথাই শুনেছি কিন্তু ভাসমান গ্রাম? সত্যি অবিশ্বাস্য। পানির ওপর জীবন ধারণ করছে মানুষ। তাও আবার যুগের পর যুগ। এই ভাসমান গ্রামগুলো আপনি দেখতে পাবেন হ্যা লং সাগর আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাতে যে প্রমোদতরী রয়েছে তাতে চড়ে। প্রমোদতরীতে চড়ে সমুদ্র দর্শনের সময় আপনি মাঝে মাঝেই সাক্ষাৎ পাবেন সমুদ্রের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুনাপাথরের পাহাড়ের। এদের কোন কোনটা দেখলে মনে হবে আপনাকে অভ্যর্থনা দিতে তোরণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার কোন কোন পাহাড় দেখলে মনে হয় এরা আপনাকে কুর্নিশ করতে মাথা ঝোকাচ্ছে। আর এই পাহাড়গুলোর ফাঁকেই দেখতে পাবেন শতাব্দী ধরে জেগে থাকা সমুদ্রের পানির উপর গড়ে ওঠা বসতি তথা ভাসমান গ্রাম।

ভাবা যায় বড় বড় নৌকার ওপর ঘরবাড়ি করে একজীবন কাটিয়ে দেয়ার কথা? আশ্চর্য লাগে না? আর এদের জীবন ধারাই এটা। এখানে ভাসমান গ্রামের সূত্রপাত মূলত উনবিংশ শতাব্দীতে। এ জনপদ সাধারণত সমুদ্রে মাছ ধরাসহ বিভিন্ন পেশায় লিপ্ত থাকাতে তাদের সমুদ্রে কাটাতে হতো দিনের পরদিন। সেই চিন্তা থেকেই মূলত ভাসমান গ্রামগুলোর উৎপত্তি। তবে প্রথমে সেখানে তারা সমুদ্রে কাটানো সময়টুকুতে বিশ্রামসহ প্রয়োজনীয় কাজ সারতো। কিন্তু ধীরে ধীরে একসময় এখানে তারা স্থায়ী বসবাস শুরু করে এবং কাটাতে থাকে কালের পর কাল। এই হলো ভাসমান গ্রামগুলোর উৎপত্তির গল্প। হ্যা লঙে সমুদ্রের বুকে চারটি ভাসমান গ্রাম রয়েছে। এগুলো হচ্ছে বা হ্যাং, কুয়া ভ্যান, ভুং ভিয়েং ও কং ডাম।
তবে ভিয়েতনাম সরকারের হস্তক্ষেপে এখন ভাসমান গ্রামগুলো আর স্থায়ী বসবাসের জায়গা হিসেবে ব্যাবহৃত হচ্ছে না। কেননা এই গ্রামগুলোর প্রধান সমস্যা বিশুদ্ধ পানি ও বিশুদ্ধ খাদ্যের অভাব, বাচ্চাদের শিক্ষাবব্যাবস্থা জনিত সমস্যা। ভিয়েতনাম সরকার ভাসমান গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যসম্মত জীবনের স্বার্থে তাদের ফিরিয়ে এনেছে সেখান থেকে। কিন্তু তাই বলে গ্রামগুলো কিন্তু এখনো আছে। আবার আগের মত ক্ষনিকের বিশ্রামের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
যেভাবে যাবেন হ্যা লং বের বুকে
ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় থেকে ১৫০ কি:মি: দূরে অবস্থিত হ্যা লং বে। (যারা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান তারা অবশ্যই জানেন ভিয়েতনাম যাওয়ার পদ্ধতি। আর যাদের এটুকু ঘাটতি রয়েছে তাদের জন্য ভিয়েতনাম ভ্রমণের বিস্তারিত ‘তথ্যসূত্র’র লিংকে দেওয়া আছে।) হ্যানয় থেকে হ্যা লং যেতে আপনার একমাত্র ভরসা স্থলপথ। তবে এই স্থলপথে বাসই একমাত্র ভরসা। কেননা এখানে ট্রেন যোগাযোগ পাবেন না। তাই বলে চিন্তার কিছু নেই। কারণ সেখানকার বাস সার্ভিস খুবই উন্নত এবং প্রতিটি বাসই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। চার ঘন্টার মত লাগবে আপনার হ্যা লঙে পৌঁছাতে। আর পৌঁছিয়েই যেন শান্তি। কেননা হ্যা লঙের মন ও চোখ ভোলানো অপরুপ সৌন্দর্য আপনার সমস্ত ক্লান্তি কর্পূরের মতো উধাও করে দিবে নিমিষে। পাশাপাশি স্থানীয়দের আন্তরিক ব্যাবহার পেয়ে ভুলেই যাবেন আপনি আগন্তুক।
Add Comment