রাহুল সাহা
১৯০৫ সালে রাশিয়ায় সংঘটিত বিপ্লবকে ইতিহাসে ব্লাডি সানডে বা প্রথম রুশ বিপ্লব বলে। অনেকের মতে এটিই পরবর্তীতে ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবকে নেতৃত্ব দেয়
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মাক্স ও ফরাসি দার্শনিক ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এর ‘সমাজতন্ত্র’ ধারণাটি বইয়ের পাতা থেকে বের হয়ে প্রথম বাস্তবে রুপ নেয় ‘মহান অক্টোবর বিপ্লব বা রুশ বিপ্লব’- এর মাধ্যমে। আমরা প্রায় সকলেই জানি ১৯১৭ সালে ঘটে যাওয়া এই বিপ্লবের কথা। যা পৃথিবীতে প্রথম সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটায়। এই বিপ্লবের ১২ বছর পূর্বে ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় আরেকটি বিপ্লব ঘটে যা ইতিহাসে ব্লাডি সানডে বা প্রথম রুশ বিপ্লব বলে পরিচিত। অনেক ইতিহাসবিদদের মতে এটিই পরবর্তীতে অক্টোবর বিপ্লবকে নেতৃত্ব দেয়।

১৯০৫ সালের ২২ শে জানুয়ারি, রবিবার তরুণ ফাদার জর্জি গ্যাপনের নেতৃত্বে যখন আন্দোলনটি সংগঠিত হয় সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন জার দ্বিতীয় নিকোলাস। তৎকালীন সকল ক্ষমতা ছিলো জারকেন্দ্রিক। পার্লামেন্ট বা সংবিধান কিছুই ছিলো না তখন, জারের নির্দেশ মতোই ঘটতো সবকিছু।
সাধারণের উপর জারবাহিনীর অত্যচার তো তখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। জারের এই স্বৈরতান্ত্রিকতায় ধীরে ধীরে জনমনে ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করে। এই ক্ষোভগুলো আরো বৃদ্ধি পায় যখন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ১৯০৪ সালে চলা ‘জাপান-রাশিয়া’ যুদ্ধ, বিরুপ আবহাওয়ায় ফসলের কম উৎপাদন ও অন্যান্য কারণবশত রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা করুণ হতে শুরু করে। একে তো শ্রমিকদের উপর মালিক পক্ষের অত্যাচার, কারখানায় অমানবিক পরিশ্রম করেও যথেষ্ট অর্থ না পাওয়া, তার উপরে আবার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি শ্রমিকদের ক্ষোভকে বাড়িয়ে তুলে।
এদিকে ক্ষোভ যত বাড়ছিলো শ্রমিকরা তত সংগঠিত হতে শুরু করলো, একত্রিত হয়ে সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে তাদের সংগঠনগুলোও শক্তিশালী হতে থাকে।
১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে শ্রমিকদের এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ক্ষোভের উপরে শেষ হাতুড়িটা মারে ‘Putilov Iron Works’ ; তারা ৪ জন কর্মীকে বরখাস্ত করে যারা- ‘Assembly of Russian Workers’ সংগঠনের সদস্য ছিলো। বরখাস্ত করার কারণে প্রায় দশহাজার কর্মী সেন্ট পিটার্সবার্গে ধর্মঘটে নামে তখন।

বিক্ষোভকারী কর্মীদের নিয়ে তাদের মতামত ও সমস্যাগুলোকে ফাদার জর্জি গ্যাপন একটা পিটিশন তৈরি করে যাতে কাজের অবস্থার উন্নতি, মজুরি বৃদ্ধি ও কার্যদিবস ৮ ঘন্টায় হ্রাস করানো
এই বিক্ষোভকারী কর্মীদের নিয়ে তাদের মতামত ও সমস্যাগুলোকে ফাদার জর্জি গ্যাপন একটা পিটিশন তৈরি করে যাতে কাজের অবস্থার উন্নতি, মজুরি বৃদ্ধি ও কার্যদিবস ৮ ঘন্টায় হ্রাস করানো (রুশ-জাপান যুদ্ধের অবসান এবং সার্বজনীন ভোটাধিকার ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত ছিলো।) এবং পিটিশন নিয়ে ২২ জানুয়ারি শীতকালীন প্রাসাদের উদ্দেশ্যে পদযাত্রার পরিকল্পনা তৈরি করে।
নির্দিষ্ট দিনেই গ্যাপনের নেতৃত্বে শ্রমিকরা সেন্ট পিটার্সবার্গের শিল্প উপ-অঞ্চলে ৬টি পয়েন্টে জড়ো হয়ে শীতকালীন প্রাসাদের দিকে এগোতে শুরু করে। এই বিক্ষোভে জড়িতদের সংখ্যা অনুমান করা হয় ৩০০০-৫০০০০। যারা একেবারে নিরস্ত্র ছিলো।

(উল্লেখ্য যে তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলো যেমন বলশেভিক, মেনসেভিকস এবং সামাজিক বিপ্লবীরা রাজনৈতিক দাবীর অভাবে মিছিলটি প্রত্যাখ্যান করেছিলো। তাদের মতে শীতকালীন প্রাসাদে পদযাত্রা কোনোও বিপ্লবী বা বিদ্রোহী কাজ ছিলো না তাছাড়া নির্দিষ্ট এই দিনে জার প্রাসাদে উপস্থিত ছিলেন না, ২১ শে জানুয়ারি [ওএস ৮ জানুয়ারি] সারসকোয়ে সেলোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।) এই নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীরা যখন প্রাসাদের দিকে এগোচ্ছিল তখন সেখানে বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় দশহাজার সেনাবাহিনী উপস্থিত ছিলো৷
সেনা অফিসাররা বিক্ষোভকারীদের প্রাসাদ চত্বরে প্রবেশের আগে থামতে বললেও তারা এগিয়ে যেতে থাকে, পরে অফিসাররা ছোটো ছোটো দলে এগিয়ে যেতে বললেও তারা না থেমে একইভাবে এগিয়ে যেতে থাকে। যার প্রেক্ষিতে কোসাকস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীরা তাদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। এই গোলাগুলির ফলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং যে যার মতো পালিয়ে যায়। ফাদার গ্যাপন নিজেও সমাবেশের পরে রাশিয়া ছেড়ে পালিয়ে যায়।

২২ জানুয়ারি এই গোলাগুলির ফলে ১৪৩-২৩৪ জনের মৃত্যুসহ ৪৩৯-৮০০ জন আহত হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পরে। জানুয়ারি মাসে প্রায় ৪,১৪,০০০ লোক কাজ বন্ধ করে দেয়।
ইউনিভার্সিটি বন্ধ করে ছাত্ররা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিলসহ সর্বসাধারণেরা অর্থাৎ সব পেশার মানুষেরাই আন্দোলনে নেমে পরে এই ঘটনাটির পর। এমনকি রাশিয়ার নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজও জারশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে (এই নৌবাহিনীর বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে পরিচালক সার্গেই আইজেনস্টাটন ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ নামক একটি চলচিত্রও নির্মাণ করে।) এই সকল বিদ্রোহী তাদের নাগরিক অধিকারের জন্য সংবিধানের দাবি করে। পরবর্তীতে এতো মানুষের চাপে জার ঘটনাদিকে বেদনাদায়ক বলে আখ্যায়িত করে ডুমা (রাশিয়ান পার্লামেন্ট) গঠন করে আন্দোলনটা থামানোর চেষ্টা করে।

এই পার্লামেন্টটি ছিলো কনসাল্টেটিভ পার্লামেন্ট যা তৈরির ৭৫ দিন পরই ভেঙ্গে জার দ্বিতীয় ডুমা তৈরি করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে দ্বিতীয় ডুমাটিও জারের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করলে জার একে ‘তাকে ও তার পরিবারকে’ হত্যার কন্সপিরেসি করার কারণে ভেঙ্গে আরেকটি ডুমা নির্বাচিত করে।
এই ৩য় ডুমাটিতে জার লিবারেলস এবং বিক্ষোভকারী কাউকে না নিয়ে তার পছন্দমত, তার সমর্থনকারী রাজনীতিবিদদের নিয়ে গঠন করে। আর এই কারণেই ৩য় ডুমাটিই তাদের ৫ বছরের টার্ম পিরিয়ড কমপ্লিট করে যা প্রথমদুটিকে জার করতে দেয়নি। ডুমা তৈরির পর পরেই জার সিস্টেম্যাটিকলি শ্রমিক সংগঠনগুলো ব্যান করে দিয়ে পুনরায় সকল কিছুর নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। এভাবে আস্তে আস্তে পুরো আন্দোলনটা থামিয়ে দিতে সক্ষম হয় জার দ্বিতীয় নিকোলাস।
Add Comment